চট্টগ্রামের সবগুলি ফায়ার স্টেশনে জনবল-সরঞ্জাম সংকট

জনবল এবং আগুন নেভানোর সরঞ্জামসহ নানা সংকটে ধুঁকছে চট্টগ্রামের সবগুলো ফায়ার সার্ভিস স্টেশন। পাশাপাশি বন্দর নগরীতে যে পরিমাণ শিল্প কলকারখানা এবং বাসাবাড়ি রয়েছে, সে অনুপাতে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সংখ্যা কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত বছর সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত হন ৫১ জন। এর মধ্যে ১৩ জন ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। এই দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ে যুক্ত হয় আগুন নেভানোর বেশ কয়েকটি আধুনিক সরঞ্জাম। যার একটি দিয়ে ২০ তলা ভবনে আগুন নেভানোর পাশাপাশি উদ্ধারকাজ চালানো যায়। আরেকটি দিয়ে কেমিক্যালের আগুন নেভানো যায়।

বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস কার্যালয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে ২০২২ সালে ৬৫৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৫৮ জন নিহত এবং ২৫২ জন আহত হন। ২০২১ সালে ৬৭০টি অগ্নিকাণ্ডে সাত জন নিহত এবং ১৯ জন আহত হন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৪৫০টি। তবে এতে কতজন নিহত হয়েছে, তা জানাতে পারেনি বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়সহ তিনটি জোনে চট্টগ্রামে ফায়ার স্টেশন কার্যালয় রয়েছে ২৫টি। এর মধ্যে জোন-১ এ রয়েছে ৯টি, জোন-২ এ রয়েছে ১০টি এবং জোন-৩ এ রয়েছে ছয়টি।

জোন-১ আছে আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশন, বন্দর ফায়ার স্টেশন, সিইপিজেড ফায়ার স্টেশন, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, সীতাকুণ্ড স্টেশন, মীরসরাই স্টেশন, সমুদ্রগামী ফায়ার স্টেশন, নিউমুরিং ফায়ার স্টেশন ও সন্দ্বীপ ফায়ার স্টেশন।

জোন-২ এর রয়েছে পটিয়া ফায়ার স্টেশন, সাতকানিয়া ফায়ার স্টেশন, নন্দনকানন ফায়ার স্টেশন, চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশন, লামারবাজার ফায়ার স্টেশন, বোয়ালখালী ফায়ার স্টেশন, আনোয়ারা ফায়ার স্টেশন, বাঁশখালী ফায়ার স্টেশন, চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশন ও কেইপিজেড ফায়ার স্টেশন।

৩ নম্বর জোনে রয়েছে কাপ্তাই ফায়ার স্টেশন, কালুরঘাট ফায়ার স্টেশন, রাউজান ফায়ার স্টেশন, ফটিকছড়ি ফায়ার স্টেশন, হাটহাজারী ফায়ার স্টেশন ও বায়েজিদ ফায়ার স্টেশন।

সবগুলো ফায়ার স্টেশনে জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে তিন ধরনের ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির স্টেশনগুলোতে ৩৭ জন করে, দ্বিতীয় শ্রেণির স্টেশনগুলোতে ২৭ জন করে এবং তৃতীয় শ্রেণির স্টেশনগুলোতে ১৫ জন করে জনবল থাকার কথা। কিন্তু প্রত্যেক স্টেশনে জনবল সংকট রয়েছে। আগুন নেভানোর সরঞ্জাম প্রয়োজন অনুযায়ী আছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়।’
আগুন নেভানোর জন্য দিন দিন পানির উৎস অর্থাৎ পুকুর ও জলাশয় কমছে উল্লেখ করে মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘এ কারণে আগুন নেভাতে পানির সংকট দেখা দেয়। নগরীর কিছু এলাকার রাস্তা সরু। এজন্য উদ্ধার অভিযানের গাড়ি ঢোকানো কঠিন হয়ে যায়। এসব স্থানে আধুনিক অনেক সরঞ্জাম নেওয়া যায় না। ফলে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় আমাদের।’

বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস কার্যালয় সূত্র জানায়, সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর বেশ কিছু আধুনিক সরঞ্জাম ফায়ার স্টেশনগুলোতে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৬৮ মিটার লম্বা টার্ন টেবল লেডার (টিটিএল)। এটি যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের বহরে। এর সাহায্যে ২০ তলা ভবনে উদ্ধার এবং অগ্নিনির্বাপণের কাজ করা যায়। এছাড়া অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য ৮৮ দশমিক ৫ ফুট লম্বা ল্যাডার, ৫৪ মিটার লম্বা ভিমা ও স্কাই লিফট, হাজমত টেন্ডার এবং কেমিক্যালের আগুন নেভানোর জন্য কেমিক্যাল টেন্ডার নামে একটি অগ্নিনির্বাপণ গাড়ি আছে।

ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম বিভাগের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হালিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের ফায়ার স্টেশনগুলোতে যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন, তা নেই। তবে সরঞ্জাম অনেক আছে। আরও নতুন নতুন সরঞ্জাম যুক্ত হবে। দিন দিন বাড়ছে বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা।’

জনবল থাকলেও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম বিভাগের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক। তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ ফায়ার কর্মী নতুন। চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক শহর। এখানে ছোটবড় ও মাঝারি অনেক শিল্প কলকারখানা রয়েছে। আছে অসংখ্য বহুতল ভবন। যে কারণে এখানে দক্ষ জনবলের পাশাপাশি আরও বেশি সরঞ্জাম প্রয়োজন।’

জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কথা স্বীকার করেছেন সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম দুলাল। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চল এলাকা। এখানে ছোটবড় অনেক কলকারখানা আছে। প্রথম শ্রেণির ফায়ার স্টেশন হিসেবে আমাদের এখানে ৩৫ জন জনবল থাকার কথা। আছে ৩০ জন। আগুন নেভানোর জন্য ছয়টি গাড়ি আছে। আরও কিছু গাড়ির চাহিদা দেওয়া হয়েছে। এগুলো পাওয়া গেলে আরও ভালো সেবা দিতে পারবো আমরা।’

জনবল কম হওয়ায় শিফটিং ডিউটি নেই বলে জানালেন আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশনের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘দিন-রাত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের কাজ করতে হয়। অতিরিক্ত ডিউটির ভাতা পাই না আমরা। তবু কোথাও দুর্ঘটনার খবর শুনলে জানপ্রাণ দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *