আসছে ডেঙ্গুর মৌসুম, সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তৈরিতে ধীরগতি

শীত মৌসুমের কারণে মাস দুয়েক বৃষ্টিপাত কার্যত না থাকায় এই মুহূর্তে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছুদিনের মধ্যে বৃষ্টিপাত শুরু হলেই আবার শুরু হবে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এর মধ্যে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নীতিমালা গ্রহণ করা না গেলে পরিস্থিতি গত বছরের চেয়েও খারাপ হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৭২৭ জন। মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। ২০২২ সালে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ৬২ হাজার ৩৮২ জন। মৃত্যু হয় ২৮১ জনের।

দেশে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ২০১৯ সালে। সংখ্যাটি ছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪। সে বছর মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের। ২০২০ সালে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ছিল আগের বছরের তুলনায় বেশ কম—এক হাজার ৪০৫। সেবার মৃত্যু হয় সাতজনের। ২০২১ সালে আক্রান্তের সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২৮ হাজার ৪২৯। সে বছর মৃত্যু হয় ৭৫ জনের।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম গত ২৫ জানুয়ারি রাজধানীতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে শিগগিরই সমন্বিত নীতিমালা করা হবে।

তাজুল ইসলাম সেদিন বলেন, ‘আমরা পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যক্রম নেওয়ার জন্য সমন্বিত ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট নীতিমালার খসড়া করেছি। এটা আমরা তাদের (ডিসিদের) দেব। গবেষণার মাধ্যমে ভেক্টরকে কিভাবে ম্যানেজ করা সম্ভব, বিদেশ থেকে সেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি।’

এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিধনে সমন্বিত যে নীতিমালা করার কথা তা (ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর পলিসি) একটি বৈঠকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বৈঠকটির পর এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রথম বৈঠকে ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর পলিসি তৈরির জন্য বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

নীতিমালাসংক্রান্ত প্রথম বৈঠকে থাকা একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘নীতিমালা তৈরির কিছু নিয়ম-কানুন আছে। এ জন্য কর্মশালা করতে হয়। তার আলোকে সবাই লিখিতভাবে বিশেষজ্ঞদের কাছে মতামত দেবেন। বিশেষজ্ঞরা তা সংশোধন করবেন। এরপর সিদ্ধান্ত হবে। এ ছাড়া কোনো বিশেষজ্ঞকে একটি নির্ধারিত সময়ের জন্য কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দিতে হয়। তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খসড়া উপস্থাপন করবেন। সেটি কিন্তু হয়নি।’

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (নগর উন্নয়ন-২) শাফিয়া আক্তার শিমু এ বিষয়ে বলেন, ‘ভেক্টর ম্যানেজমেন্টের বেশ কিছু কার্যক্রম বিভিন্ন জেলায় চলমান। এ ছাড়া খসড়াও মোটামুটি হয়ে গেছে। আমরা রেজল্যুশন করে কীটতত্ত্ববিদদের একটা রিপোর্ট দিতে বলেছি, সুপারিশসংক্রান্ত। উনারা রিপোর্ট দিলে আমরা পরবর্তী কার্যক্রমে যাব।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রগ্রাম ম্যানেজার একরামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বলা যায়, ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশে ১২ মাসের রোগ। এত দিন আমরা দেখেছি আগস্টে ডেঙ্গুর পিক ছিল। গেল বছর অক্টোবর-নভেম্বরে পিক হলো। তার মানে ডেঙ্গুর প্রকোপ আগের আট মাসের জায়গায় এখন ১০ মাস থাকবে।’

একরামুল হক বলেন, ‘ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর পলিসির কোনো বিকল্প নেই। তবে আমি মনে করি, মশা মারা কোনো সমাধান নয়। কারণ প্রকৃতিতে একজন মানুষের বিপরীতে প্রায় দেড় কোটি মশা থাকে। এত মশা মেরে শেষ করা যাবে? সুতরাং আমাদের দরকার মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা। ভেক্টর কন্ট্রোল ম্যানেজমেন্ট সারা বছর চালু রাখা গেলে অ্যাডাল্ট মশাও কমবে, সঙ্গে উৎপত্তিস্থলও ধ্বংস হবে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডেঙ্গু কমাতে হলে আমাদের দরকার কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতা বাড়ানো। প্রয়োজন কীটতত্ত্ববিদ, কীটতাত্ত্বিক ল্যাবরেটরি, কীটতাত্ত্বিক গবেষণা এবং মশা নিধনের নানা ধরনের কীটনাশক ও নানা ধরনের পদ্ধতি। এগুলো নিয়েই জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করা দরকার। যার নাম হবে জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ কর্মকৌশল। প্রতিটি শহরে অর্থাৎ ন্যূনতম ৬৪ জেলায় কীটতাত্ত্বিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।’

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার এ বিষয়ে বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা স্বাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়া দরকার। সেখানে বিভিন্ন ধরনের ল্যাবরেটরি থাকতে হবে। সেখানে অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকজনকে উচ্চ বেতনে নিয়োগ দিতে হবে। তাঁরা বছরব্যাপী মশা নিয়ে কাজ করবেন। মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত কীটনাশক ও মশাবাহিত রোগ নিয়ে গবেষণা করবেন। সরকারকে এ বিষয়ে পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র দেবেন তাঁরা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সারা দেশে বাস্তবায়ন করবে সে পরামর্শ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *